ঈশ্বরদীর নারী শ্রমিকেরা বছরের পর বছর মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। একই কর্মক্ষেত্রে পুরুষের সমান কায়িক পরিশ্রম করেও পারিশ্রমিক প্রাপ্তির ক্ষেত্রে দারুন ভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে নারী শ্রমিকগণ। এ নিয়ে তাদের হাজারো অনুযোগ থাকলেও তাদের কথা শোনারও যেন কেউ নেই। ফলে অনেকটা বাধ্য হয়েই নারী শ্রমিকদের জীবন-জিবীকার সংগ্রাম চলছে পরিহাস ও প্রতিবন্ধকতা সাথী হয়ে। অগ্রসরমান নারী নীতিতে নারীদের সমান অধিকারের বিষয়টির বাস্তবায়ন এক্ষেত্রে প্রায় অনুপস্থিত।
ঈশ্বরদীর কর্মজীবী নারীদের মধ্যে কৃষিকাজ ও ধান চাতালের শ্রমিক হিসেবে সুখ্যাতি এবং এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে নারী শ্রমিকদের অংশ গ্রহণ রয়েছে চোখে পড়ার মতো। উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তম ধান-চাতাল মোকাম ঈশ্বরদীতে প্রায় ৫ শতাধিক ধান-চাতালে পুরুষদের পাশাপাশি কর্মরত রয়েছে প্রায় ৩ হাজারেরও বেশি নারী শ্রমিক। প্রতিদিন ধান সিদ্ধ থেকে শুরু করে চাউল উপযোগী করতে প্রতিটি কর্মকান্ডেই নারী শ্রমিকদের রয়েছে প্রত্যক্ষ অংশ গ্রহন। তারা পুরুষদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মেতে থাকেন কঠোর কায়িক পরিশ্রমে। পুরুষদের সাথে তাল মিলিয়ে সমান তালে পরিশ্রম করলেও মজুরি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে দারুন বৈষম্যের শিকার হন এসকল নারী শ্রমিকরা।
জয়নগর মোকামে অবস্থিত একটি ধান-চাতালের নিয়মিত নারী শ্রমিক রেখা বেগম জানান ওদের মতো (পুরুষ শ্রমিক) আমরাও প্রতিদিন ধানে পা দেওয়া, চাতাল ঝাড়ু দেওয়া থেকে শুরু করে সকল কাজ করে থাকি। তবে মজুরি যা পাই তা পুরুষের অর্ধেক। একই সুরে কথা বললেন রেবেকা বেগম। তার আক্ষেপ একটু বেশিই। বলছিলেন- ‘খাটুনির বেলায় সমান করলেও ট্যাকা পায় অর্ধেক’। তারপরেও নানা বঞ্চনার শিকার হতে হয় দাবী করে শ্রমিক মিনা খাতুন জানালেন, দফায় দফায় পুরুষদের মজুরি বাড়লেও তাদের এখনও সন্তুষ্ট থাকতে হয় খুদ আর গুড়া নিয়ে। নারগিছ খাতুনের অভিযোগটি একটু ভ্ন্নিতর। আক্ষেপের চেয়ে অভিমানই তার বেশি। তিনি জানালেন স্বামী-সংসারে নির্যাতিত হয়ে কিংবা তীব্র অভাবের যাতনায় ভাগ্য তাদের চাতাল শ্রমিক করেছে। মালিকরা অত্যাধিক পরিশ্রম করিয়ে নিলেও মজুরির বিষয়ে বরাবরই বৈষম্য করে থাকেন।
সবজি প্রধান এলাকা খ্যাত ঈশ্বরদীর উন্নয়ন অগ্রগতিতে কৃষি অগ্রণী ভূমিকা রাখলেও এই কৃষি উৎপাদনে সম্পৃক্ত নারীদের উন্নয়ন হয়নি একটুকুও। এক্ষেত্রেও বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে নারীদের। নামমাত্র মজুরিতে দিনভর ফসল উৎপাদনে নারী শ্রমিকেরা নিবেদিত থাকলেও তাদের বিষয়ে সু-নজর নেই সংশ্লিষ্টদের। ফলে সমান পরিশ্রম করেও অর্ধেক বা তারও কম মজুরিতে সন্তুষ্ট থাকতে হয় নারী শ্রমিকদের। ঈশ্বরদীর অন্যতম সবজি প্রধান এলাকা মূলাডুলি ও ছলিমপুর ইউনিয়নের নারী কৃষি শ্রমিকরা জানান কাজের ধরন অনুসারে কৃষি কাজে নিয়জিত পুরুষ শ্রমিকরা প্রতিদিন ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা মজুরিতে কাজ করে থাকে। একই কাজ নারী শ্রমিকদের দিয়ে করানো হয় মাত্র ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়। রেহেনা খাতুন নামের এক শ্রমিক জানান, পুরুষ শ্রমিকদের পাশাপাশি প্রতিদিন তিনি সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত শিম ক্ষেতে কাজ করেন। পুরুষ শ্রমিকদের দিন মজুরি ৬০০/৭০০ টাকা দেওয়া হলেও তাকে দেওয়া হয় মাত্র ৩০০ টাকা। জামিলা খাতুন নামের অপর এক নারী শ্রমিক জানান, মূলাডুলির শিম, বেগুন, ঢেঁড়স, বরবটিসহ বিভিন্ন সবজি ফসল উৎপাদনে প্রায় ২ হাজার নারী শ্রমিক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে নিয়জিত থাকে। তারা সকলেই মজুরিসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে চরমভাবে বৈষম্যের শিকার হন।
অপর দিকে মূলাডুলিতে বিভিন্ন আদিবাসী নারী শ্রমিকদের বেলায় করা হয় চরম বৈষম্যতা। একই কাজ আদিবাসী নারী শ্রমিকরা করলে তাদের দেওয়া হয় মাত্র ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। জীবন-জীবিকার তাগিদে অনেকটা বাধ্য হয়েই তারা এ অন্যায় ও অযৌক্তিক নিয়ম মেনে নেন বলেনও জানান তারা। বারবি কস্তা নামের এক আদিবাসী নারী শ্রমিক অনেকটা ক্ষোভের সঙ্গে জানালেন, কর্মক্ষেত্রে তারা কি দারুন বৈষম্যের শিকার হন সে কথা। তার মতে শুধুমাত্র মূলাডুলি ইউনিয়নেই প্রায় ৫ শতাধিক আদিবাসী নারী শ্রমিক কৃষি উৎপাদনে সরাসরি সম্পৃক্ত। তারা ধান রোপন, পরিচর্যা ও মাড়াই থেকে শুরু করে সবজি ফসলের মাচা তৈরি ও পরিচর্যার কাজ করে থাকেন। ক্ষেত্র বিশেষ বাজারজাত করনেও এসকল আদিবাসী নারী শ্রমিক প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখেন। তার পরেও বৈষম্য তাদের পিছু ছাড়েনা। সাধারণ নারী শ্রমিকদের চেয়েও তাদের দেওয়া হয় কম মজুরি।
নারী শ্রমিকদের মজুরি বৈষম্যের বিষয়ে জানতে চাইলে ঈশ্বরদী উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকতা নাজনীন আক্তার জানান, সরকারী ভাবে এসব বিষয়ে কোন নির্দেশনা না থাকায় তেমন কোন পদক্ষেপ নেওয়া যাচ্ছে না। তবে নারীদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচীর মাধ্যমে স্বাবলম্বী করে তোলা হচ্ছে। নারীরা তাদের অধিকারের বিষয়ে আগের চেয়ে অধিক সচেতন হয়েছেন দাবি করে তিনি বলেন, কর্মক্ষেত্রে পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের বৈষম্য থাকা উচিত নয়।
ঈশ্বরদী উপজেলা নির্বাহী অফিসার পি এম ইমরুল কায়েস বলেন, নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা হলেও সরকারীভাবে এ বিষয়ে কোন নীতিমালা নেই, তবে নারীদের এসব বৈষম্য রোধে নারীদের প্রতিবাদী হতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট কর্মস্থল কিংবা সংস্থাগুলোর ইতিবাচক ভূমিকা রাখা উচিত।
Leave a Reply