ঈশ্বরদীস্থ বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএসআরআই) অনিয়ম দুর্নীতির আখরা হিসেবে পরিণত হয়েছে। নানা কৌশলে আটকে দেয়া হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির ৩৯ জন গবেষকদের পদোন্নতি। মহাপরিচালক (ডিজি) ড. আমজাদ হোসেনের নানা অনিয়ম, দূর্নীতি আর অব্যবস্থাপনার ফলে জাতীয় এই প্রতিষ্ঠানটির স্বাভাবিক গবেষণা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। ফলে অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে দেশে চিনি শিল্প রক্ষানাবেক্ষন ও উন্নয়ন তরান্বিতকারী কেন্দ্রীয় এই প্রতিষ্ঠানটি।
একাধিক সুত্র জানায়, বর্তমান ডিজির মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ৩১ অক্টোবর। সাধারণত ডিজির পরের পদ চিফ সায়েন্টিফিক অফিসার (সিএসও) থেকে জেষ্ঠ্যতার ভিত্তিতে মহাপরিচালক (ডিজি) নিয়োগ দেয়া হয়। গত কয়েক বছর ধরে আদালতের ‘রায়’ বাস্তবায়ন না করে মহাপরিচাল আমজাদ হোসেন এর কূটকৌশলে এই পদটি খালি রয়েছে। ফলে সিএসও পদ খালি দেখিয়ে নিজের মেয়াদ বাড়ানো পাঁয়তারা করছেন ডিজি ড. আমজাদ হোসেন।
গত ৫ বছরের অধিক সময় ধরে দায়িত্ব পালন করা এই ডিজির বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। সমন্বিত গবেষণা জোরদারকরণ প্রকল্প, সাথী ফসল প্রকল্প, পরিচ্ছন্ন বীজ বিতরণ প্রকল্প এবং মধু প্রকল্প থেকে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। বিএসআরআই এর আওতাধীন পাবর্ত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য পাইলট প্রকল্পে বিশাল অংঙ্কের টাকা বরাদ্দ রয়েছে। টাকা হাতিয়ে নিতে সেই প্রকল্পের পরিচালক হয়েছেন মহাপরিচালক আমজাদ হোসেন নিজেই। এছাড়াও প্রশিক্ষণ কর্মশালায় অংশ না নিয়ে প্রশিক্ষণ ভাতা ও টিএডিএ নেওয়ার মত ঘটনাও ঘটছে। বিএসআরআই কতৃর্ক পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের ক্ষেত্রেও নিয়ম না মেনে গোপন আঁতাতের মাধ্যমে কতিপয় মূখচেনা ব্যক্তিকে দিয়ে দীর্ঘদিন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে সাথী ফসল গবেষণা কর্মসূচির জন্য মোট বরাদ্দ ছিল ৫ কোটি টাকা। প্রতিটি প্লটে কৃষকদের ৩০ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টাকা বরাদ্দ থাকলেও কৃষক পর্যায়ে কম টাকা দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। মাত্র আড়াই হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে বলে জানান ভুক্তভোগী কৃষকরা।
কয়েকজন কৃষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাংবাদিকদের জানান, শুরুতে আড়াই হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে পরে আর কোন যোগাযোগ করেনি কেউ। ফলে নামমাত্র এই অর্থ পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন কয়েকজন কৃষক। তারা বলেন, আমরা লেখাপড়া জানি না। শুনেছি অনেক টাকা পাব কিন্তু এই টাকা দিয়ে আমাদের সাথে প্রতারণা করেছে। আমরা এই টাকা আর নিতে চাইনা।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে সাথী ফসল গবেষণা কর্মসূচির পরিচালক ড. আবু তাহের সোহেল বলেন, আমি প্রকল্প মনিটরিং করেছি। প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে সংশ্লিষ্ট কমিটি। এসময় তিনি মোবাইলে কোন তথ্য না নিয়ে অফিসে আসার কথা বলেন এই কর্মকর্তা।
বিজ্ঞানী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ২০১১ সালের পর থেকে এ প্রতিষ্ঠানে চিফ সায়েন্টিফিক অফিসার (সিএসও) পদের ১৬ জন বিজ্ঞানীকে প্রাপ্য পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। ফলে তাদের পদ এখনও শূন্য। তিনজন সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার (এসএসও) এবং দুটি প্রিন্সিপাল সায়েন্টিফিক অফিসার (পিএসও) পদ ১১ বছর ধরে খালি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মামলার রায় বাস্তবায়ন না করায় প্রতিষ্ঠানের প্রায় সব ধরণের কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়েছে।
পদের জ্যেষ্ঠতা পেতে প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত বিজ্ঞানী আতাউর রহমান, গাজী আকরাম হোসেন ও আবুল কালাম আজাদ বাদী হয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব, সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও বিএসআরআই’র মহাপরিচালককে আসামি করে ২০১১ সালে উচ্চ আদালতে মামলা করেন। মামলার রায় বাদীর পক্ষে আসে। মন্ত্রণালয়, হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগ এবং রিভিউ আদেশ পর্যালোচনা করে হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের রায়ের আলোকে জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণের নির্দেশ দেয়। কিন্তু উচ্চ আদালতের রায়ের আদেশ অনুসরণ না করে শুধুমাত্র আইনজীবীর মতামতের ভিত্তিতে মহাপরিচালক জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করেন যা আদালত অবমাননার সামিল। এতে বাদীর জ্যৈষ্ঠতা ক্ষুন্ন হয়েছে। বিধায় পরবর্তীতে কোর্ট কন্টেম মামলা হয়। যা বিচারাধীন রয়েছে।
তারপর থেকে জাতীয় এই প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীদের পদোন্নতির পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। সম্প্রতি ৪০ জন বিজ্ঞানীকে নিয়ে অভ্যন্তরীণ ওয়ার্কশপের একটি বৈঠক শুরু হলে মহাপরিচালকের উপস্থিতিতে প্রমোশন চাই বলে শ্লোগান দিতে থাকেন তারা।
বিজ্ঞানী গাজী আকরাম হোসেন বলেন, ‘গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। শুধু পদোন্নতি আটকে থাকার কারণেই গবেষণা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা ঠিকমত কাজ করতে পারছে না।’
রঞ্জিত চন্দ্র কবিরাজসহ আরও কয়েকজন বিজ্ঞানী একই মতামত প্রদান করে। এই পরিস্থিতিতে জ্যেষ্ঠতা বিধিমালা লঙ্ঘন করে সম্প্রতি কৃষি মন্ত্রনালয়ে ২৬ জনের একটি চিঠি পাঠান বিএসআরআই’র মহাপরিচালক ড. আমজাদ হোসেন। এ তালিকা নিয়েও শুরু হয়েছে বিতর্ক।
বিএসআরআই’র মুখ্য বৈজ্ঞানিক কমকর্তা ড. কুয়াশা মাহমুদ বলেন, ২০১৫ সালে আমার সিএসও পদে পদোন্নতি হওয়ার কথা। কিন্তু মামলার কারণে এখনও তা হয়নি। সর্বশেষ আমাকে ও ইসমোতয়ারা কে পরিচালক করা হয়েছে। অন্যান্য মূখ্য বৈজ্ঞানিক কমকর্তাদের সিএসও পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়নি।
মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আতাউর রহমান বলেন, ‘মামলার অজুহাতে বিজ্ঞানীদের পদোন্নতি বন্ধ রাখা হয়েছে। এ নিয়ে প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে বিজ্ঞানীদের।
এবিষয়ে বিএসআরআই মহাপরিচালক (ডিজি) ড. আমজাদ হোসেন অভিযোগকারীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আমি এই পদে আর থাকতে চাই না। তাদের মামলার কারণেই সিএসও পদে পদোন্নতি আটকে আছে, এখানে আমার কিছু করার নেই।’ গবেষণা কার্যক্রম যথানিয়মেই চলছে। এরই মধ্যে ২৬ জনের তালিকা পদোন্নতির জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।’
এদিকে ড. আমজাদ হোসেন এর শিক্ষা জীবনের সাথে বর্তমানের রাজনৈতিক দর্শন সম্পূর্ণ্য সাংঘর্ষিক। তার একাধিক সহপাঠি জানান, স্কুল ও কলেজ জীবনে তিনি জামায়াত/শিবির সংগঠনের সমর্থক ছিলেন। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ও বিএসআরআইতে তিনি সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন। জামায়াতের সাবেক আমীর মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত মাওঃ মতিউর রহমান নিজামীর ভাগ্নে হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতেন। জোট সরকারের সময় নিজামী যখন কৃষি মন্ত্রী ছিলেন বিএসআরআইতে তিনি দাপটের সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে তিনি ভোল পাল্টিয়ে আওয়ামীলীগার হয়ে যান। এই বিষয়টিও গুরুত্বের সাথে অধিকতর তদন্ত হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন অনেকে। এই বিষয়টি জানতে তাঁর (ডিজি) মুঠোফোনে বার বার ফোন দেওয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
Leave a Reply