ঈশ্বরদীর নির্মাণাধীন রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. জাহেদুল হাছান এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও দূর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। আর সেই অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁর পদত্যাগের দাবীতে ঈশ্বরদীতে বিক্ষোভ সমাবেশ, মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ঈশ্বরদী শহরের উপজেলা সড়কে এসব কর্মসূচী পালন শেষে আড্ডা খানা রেষ্টুরেন্টে সংবাদ সম্মেলন করেন রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রায় ৫ শতাধিক বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। সে সময় বিক্ষুদ্ধ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ‘যোগ্য লোক চাই, অযোগ্য এমডিকে নয়, প্রাতিষ্ঠানিক ফ্যাসিবাদ নিপাত যাক, এনপিসিবিএল মুক্তি পাক, বি.এ.এফ.সি এর অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধ হোক, এনপিসিএবল স্বাধীন হোক’ শিরোনামে বিভিন্ন স্লোগান দেন।
অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষে সিনিয়র সহকারী ব্যবস্থাপক ফাহিম শাহরিয়ার তুহিন লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পের বর্তমান প্রকল্প পরিচালক এবং নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (এনপিসিবিএল)-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. জাহেদুল হাছানের বিরুদ্ধে গুরুতর অনিয়ম, চরম অযোগ্যতা, দুর্নীতি, প্রশাসনিক স্বোচ্ছাচারিতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক ফ্যাসিবাদের অভিযোগে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে।
এই স্বৈরাচারি, অদক্ষ, অযোগ্য ব্যবস্থাপনা পরিচালকের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে এনপিসিবিএল-এর সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ বরাবরই সোচ্চার ছিলো এবং এরই ধারাবাহিকতায় গত ৯ দিন (২৮ এপ্রিল থেকে ৬ মে ২০২৫) বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করেছেন।
লিখিত বক্তব্যে ফাহিম শাহরিয়ার তুহিন অভিযোগ করেন, প্রকল্প পরিচালক ড. জাহেদুল হাছান বর্তমানে রূপপুর প্রকল্পের একাধিক অতি গুরুত্বপূর্ণ পদ কুক্ষিগত করে রেখেছেন। একাধারে তিনি রূপপুর পারমানবিক কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প পরিচালক এবং অপারেটিং অর্গানাইজেশন এনপিসিবিএল এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং প্রধান মানব সম্পদক কর্মকর্তা, প্রধান অর্থ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং স্টেশন ডিক্টেরসহ সকল গুরুত্বপূর্ণ পদ একাই দখল করে রেখেছেন। যা একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র অপারেটিং কোম্পানির ক্ষেত্রে নজিরবিহীন।
প্রায় এক দশক আগে এনপিসিবিএল গঠিত হলেও অদ্যবধি কোনো সার্ভিস রুলস প্রকাশ করা হয়নি। ফলে নেই কোন অর্গানোগ্রাম, দায়িত্বের সুস্পষ্ট বণ্টন, পদোন্নতি, বরং জেকে বসেছে একগুচ্ছ গ্রেড ও বেতন বৈষম্য এবং অন্যান্য ব্যাসিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বছরের পর বছর টাকা জমা রাখার পরেও কোন কর্মকর্তাকেই তার সিপিএফ একাউন্ট নম্বর জানানো হয়নি, এমনকি এই টাকা কোথাও ইনভেস্টও করা হয়নি। বাংলাদেশের কোম্পানি আইনের ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোন জ্ঞান না থাকা একজন অযোগ্য ব্যক্তির অদক্ষতার কারণে হাজার হাজার মেধাবী কর্মকর্তা, কর্মচারির ভবিষ্যত আজ হুমকির মুখে। এক দশকেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এনপিসিবিএল এর প্রায় ১,৮০০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে প্রায় ১,৫০০ জনের জন্য এখনো প্রকল্প এলাকায় নূন্যতম বসার ব্যবস্থা, টয়লেট, স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা ব্যবস্থার মত ব্যাসিক বিষয় নিশ্চিতকরণেও কোন ভ্রুক্ষেপ নেই এমডির। এর ফলে প্রতিদিন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চরম দূর্ভোগের মধ্যে দায়িত্ব পালন করছেন, বিশেষত নারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। তার চরম অমানবিক আচরণের পরিচয় পাওা যায় প্রকল্পে বাঙ্গালীদের খাবার উপযুক্ত একমাত্র ক্যান্টিনটিও বন্ধ রাখার মাধ্যমে, যার পিছনে রয়েছে টেন্ডার বাণিজ্যের অভিযোগ। মেডিকেল ইমার্জেন্সিসহ যে কোন অতি জরুরী ইস্যুতেও কর্মকর্তাদেরকে পাসপোর্ট এনওসি ইস্যু না করে চরম স্বেচ্ছাচারিতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই। বন্ধ করে দিয়েছেন পবিত্র ওমরাহ করার সুযোগ, হিন্দু ধর্মালম্বীদের জন্য যে কোন তীর্থস্থান ভ্রমণ।
লিখিত বক্তব্যে ফাহিম শাহরিয়ার তুহিন আরও বলেন, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন, উচ্চ সংবেদনশীল ও কৌশলগত গুরুত্ববহ প্রকল্প হিসেবে এর নির্মাণ, কমিশনিং এবং অপারেশন এর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্মচারীরা দফায় দফায় ড. জাহেদুল হাছানের সাথে সার্ভিস রুল প্রদান, প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বতন্ত্রতা সহ বিভিন্ন বৈষম্য নিয়ে আলোচনা করে আসছে। কিন্তু তিনি সেসব বিষয়ে কোন পদক্ষে গ্রহণ না করে উল্টো কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অযৌক্তিক, অমানবিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন। যে কোন ন্যায্য কথা বলতে গেলেই এমডি তাদের চাকরিচ্যুত করা ও চাকরি ছেড়ে চলে যেতে বলেন। রাশিয়া থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অনেকেই শুধুমাত্র তার এই সকল অব্যবস্থাপনার কারণেই চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, এ পর্যন্ত এনপিসিবিএল থেকে প্রায় জনের অধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। তবে চাকরি ছেড়ে গেলেও সিপিএফ, গ্রাচুইটি, অভিজ্ঞতা সনদ, এনওসি কিছুই দেওয়া হয় নাই সেই কর্মকর্তা কর্মচারীদেরকে।
লিখিত বক্তব্যে ফাহিম শাহরিয়ার তুহিন আরও অভিযোগ করেন, এনপিসিবিএল এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হওয়ায় নিজের একক ক্ষমতাবলে তিনি গত জুলাই-আগস্ট থেকেই দফায় দফায় ২৫ জনের অধিক কর্মকর্তা এবং সর্বশেষ গত ২৯ এপ্রিল নয়জন কর্মকর্তার প্রকল্পে প্রবেশাধিকার কেড়ে নেন। তিনি বলেন, রূপপুর প্রকল্পের কন্ট্রাক্ট ম্যানেজমেন্টে তিনি একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে রেখেছিলেন, যাতে কোনো জবাবদিহিতা না থাকে। গত ২০১০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৬২ বার বিদেশ সফরের মাধ্যমে তিনি ব্যক্তিগত সুবিধা আদায়ের সুযোগ নিয়েছেন এবং ইচ্ছাকৃতভাবে অন্য কাউকে সম্পৃক্ত না করে পুরো ব্যবস্থাপনাটি নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন। এমনকি তার আত্মীয় বিবেচনায় পরমাণু শক্তি কমিশনের এক কর্মকর্তাকে যোগ্যতার ঘাটতি থাকা স্বত্বেও বারবার বিদেশ ভ্রমণ এর সুযোগ দিয়েছেন।
অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের উপ-সহকারী ব্যবস্থাপক মোঃ রুবেল হোসেন, সিনিয়র সহকারী ব্যবস্থাপক শহিদুল ইসলাম,সহকারী ব্যবস্থাপক হালিম সরকার, ফোরম্যান পারভেজ আহম্মেদ, টেকনিশিয়ান রমজান আলী সহ প্রায় ৫ শতাধিক কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ।
এসব বিষয়ে অভিযুক্ত রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. জাহেদুল হাছান এর সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ব্যস্ত রয়েছেন, পরে কথা বলবেন বলে মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন।
Leave a Reply